Prem, Khalil Mahmud, খলিল মাহ্মুদ [the snowy day read aloud .TXT] 📗
- Author: Khalil Mahmud, খলিল মাহ্মুদ
Book online «Prem, Khalil Mahmud, খলিল মাহ্মুদ [the snowy day read aloud .TXT] 📗». Author Khalil Mahmud, খলিল মাহ্মুদ
প্রথম পর্ব – অবতারণা
এটা একটা গল্প। মনে মনে এ গল্প বহু আগে লেখা শেষ হয়ে গেছে। এরকম অসংখ্য গল্প মনে মনে লেখা শেষ হয়ে জড়ো হয়ে আছে অনেক বছর ধরে। সেগুলো খাতায়, ব্লগে বা ফেইসবুকের পাতায় কখনো লেখা হয় নি, কোনোদিন হবে বলেও মনে হয় না। সময় নেই। সময় পেলেই ওগুলো মনে মনে পড়ি। অনেক গল্প মুহূর্তে সৃষ্টি হয়ে একটু পরই হারিয়ে যায়, অর্থাৎ, ওটা কী গল্প কোন গল্প ছিল তা নিজেই ভুলে যাই। ওটার কথা ভাবতে ভাবতে আরো অনেক গল্প লেখা হয়ে যায়, কিন্তু হারানো গল্পটা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, এমন থিমের উপর একটা কবিতাও আছে আমার। কবিতার নামটা অবশ্য এখন মনে পড়ছে না।
কিন্তু আপনারা ভাবুন তো, ‘আকাশযাত্রা’ শব্দটি দ্বারা আপনাদের মনে আদৌ কোনো গল্পের চিত্র ফুটে ওঠে কিনা। কিংবা, আপনারা ঠিক কী ধরনের গল্পের কথা কল্পনা করতে পারছেন, তা আমাকে বলুন। আপনাদের চিন্তার সাথে আমার চিন্তাপথের একটা সামঞ্জস্য কিংবা বৈসাদৃশ্য বোঝার জন্যই সবিনয়ে এটা জানতে চাইছি।
পুরোনো গল্পগুলো সচরাচর রাতে শুয়ে পড়ার পর, যখন দৃশ্যমান বস্তুগুলো ধীরে ধীরে চোখের ভেতর ডুবে যেতে থাকে, তখনই উদ্ভাসিত হতে থাকে। একটার পর একটা, উপর্যুপরি গল্পগুলো মগজে ভিড় করে, কিলবিল করে মগজের তন্তুগুলোর ভেতর, কামড়ায়, সুড়সুড়ি দেয়। আমাকে লিখে রাখার জন্য প্রণোদিত করে। কিন্তু, আমি ঘুমোতে চাই। এবং চোখ বন্ধ করি।
বাইরের ঝলমলে আলো থেকে সুমিহি রশ্মিগুলো চাঁদের জোসনার মতো, কিংবা রোদের ঝিকিমিকিতে বাতাসে বাঁকখাওয়া বৃষ্টির ঝাঁকের মতো আমার ছিমছাম অন্ধকার ঘরের জানালা দিয়ে নরম নীরব শব্দে ঢুকে পড়ে এক মনোরম দোদল্যমান আলো-আঁধারীর সৃষ্টি করে। সফেদ মশারি আচ্ছাদিত আমার নির্জীব খাটিয়ার চারপাশটা তখন রাজকীয় পালঙ্কের মতো মহিমান্বিত হয়ে ওঠে।
গতরাতে শুতে একটু দেরি হলো। গতরাতটা ছিল আমার গজলের রাত। আমার একেকটা রাত, একেকটা সময়, বলা চলে একেকটা সপ্তাহ একেক ধরনের গানের ভেতর প্রবাহিত হয়। গানে আমি সর্বভুক। সব ধরনের গান থেকেই আমি নির্যাস পেতে ভালোবাসি। তবে, রাগপ্রধান গানে আমার অনুরাগ সবচাইতে বেশি। ধীরলয়ে গান বাজতে থাকবে। সুরে সুরে অন্ধকার জীবন্ত হবে; আমার ঘরের শূন্যতা দুলে উঠবে সুরের মূর্ছনায়; আমি জেগে থাকবো, কিংবা ঘুমিয়ে- গানে গানে আমারও সর্বাঙ্গ দুলবে। আমার মনে হবে, আমি বেহেশতখানায় সুখনহরের উপর শুয়ে আছি। সুখে উপচে পড়ছে পৃথিবীর হৃদয়। আমার খুব ভালো লাগে। আমি হারিয়ে যেতে থাকি, জাগরণে, কিংবা স্বপ্নের ভেতরে।
এমন সময় আমার খাটিয়াটি দুলে উঠলো। আমার চোখ মুদে আসছে ঘুমে, কিংবা আবেশে, সুখের আতিশয্যেও হতে পারে। আমি দেখতে পাই, দক্ষিণ দিকের দেয়ালটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে খুলে গেল, যেমন বিরাটকায় ফটকের দরজা দুজন প্রহরী দু’দিকে টেনে খুলে দেয়। আমি খাটিয়ার আরামপ্রদ শয্যায় শুয়ে আছি। খাটিয়াটি ধীরে ধীরে বের হয়ে এলো। ধীরে ধীরে...
ধীরে ধীরে ধীরে...
আকাশে মেঘ নেই। চাঁদ নেই। আছে শুধু অগুনতি তারারা। শহরের সর্বোচ্চ অট্টালিকার ছাদ পেরিয়ে আমার আকাশযান খাটিয়া আমাকে নিয়ে নভোবিহারে উড়ে চলছে। মন্থর গতি আস্তে আস্তে বাড়ছে।। বাড়ছে। বাতাস কেটে উড়ে যাচ্ছি।
আমি উড়ে যাচ্ছি, উড়ে যাচ্ছি…
শো শো শব্দে বাতাস কেটে, দু’দিকে উচ্ছ্বসিত তরঙ্গ তুলে উড়ে যাচ্ছি…
সুদৃশ্য গ্রামগুলো দেখে আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম। আকাশের ভেতর ভেসে আছে গ্রামগুলো; গ্রামগুলো বসে আছে ঢেউতোলা নদীর পাড় ধরে। ছুটে চলছে নদী কলকল সঙ্গীতের ছন্দে। গ্রামের মাথা ছাপিয়ে শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে দেবদারু, বটগাছ, এক-মাথা তালগাছ। এগুলো আলোর গাছ। ঝলমল করছে আলোর নানাবাহারের গাছগুলো। লাল-নীল-হলুদ-সবুজ নানান রঙের আলোয় ভরা গাছের পাতাপল্লব। বনের পর বন। সুঠাম দেহে সটান দাঁড়িয়ে থাকা অজস্র ঘন গাছের পায়ের ফাঁক গলে বহুদূর আমার দৃষ্টি চলে যায়। ধু-ধু, ধু-ধু দৃষ্টি চলে যায়, শুধু গাছ আর গাছ, গাছের পর গাছ, ঝলমলে আলো গাছ, চোখ-ধাঁধানো স্বপ্নের মতো গাছ।
বন-বনানির উপর দিয়ে আমি খাটিয়ায় ভেসে চললাম। আলোর সমুদ্র থই থই করছে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে পরীরা। ওরা যখন আমার পাশ দিয়ে উড়ে যায়, ওদের পাখার নরম ঝাপটায় আমার মন আন্দোলিত হয়। এমন সময়, অনেক পরীর মাঝখান থেকে পাখির মতো নেমে এসে আমার পাশে বসলো হেলেনা। হেলেনাকে দেখলাম কত বছর পর তা আমার হিসাবে নেই। কিন্তু ও আমাকে মিষ্টি হেসে বললো- এখানে সময়ের হিসাব রাখে না কেউ। তুমিও সময় ভুলে যাও।
১৫ আগস্ট ২০১৯
4
আকাশযাত্রা
দ্বিতীয় পর্ব - রামালার প্রেম
রামালা স্কুলজীবন থেকেই গানে নাম করেছিল। স্কুলের যে-কোনো কালচারাল ফাংশানে ওর গান ছিল মূল আকর্ষণ। শুধু আমাদের স্কুলেই না, অন্যান্য স্কুলেও ওকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হতো, আর থানা সদরে সম্মিলিত ফাংশনগুলোতে ওর জন্য শুধু আমরা সহপাঠীরা না, আমাদের পুরো স্কুলই গৌরব বোধ করতো।
স্কুল সেকশন পেরিয়ে যখন কলেজে উঠলো রামালা, ওর নামডাক আরো বহুগুণ বেড়ে গেল। স্থানীয় ক্লাবগুলোতে মাঝে মাঝে শহর থেকে বড়ো শিল্পী এনে সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেখানে অবধারিতভাবে রামালার ডাক পড়তো। মজার বিষয় হলো, আমন্ত্রিত শহুরে শিল্পীদের দু-চারটা গানের পরই দর্শক সারি থেকে সমস্বরে ‘রামালা’ ধ্বনি উঠতো। রামালা একবার স্টেজে উঠলে সেদিন অন্য শিল্পীরা ফ্লপ হতো।
সে সময়ে আমরা আজকের মতো ‘সেলিব্রেটি’ শব্দটার সাথে বহুল পরিচিত ছিলাম না, আমরা ‘তুমুল নামডাক’ শব্দটা ব্যবহার করতাম, যার সাথে আজকের ‘সুপার সেলিব্রেটি’ শব্দটাই প্রযোজ্য।
যে-কোনো গানের আসরে রামালা আমাকে সঙ্গে নিত। ওর পাশে আমাকে বসিয়ে গান গাইত। বলাই বাহুল্য, রামালার পাশে বসতে পারা আমার জন্য তুমুল সুখ ও আনন্দের ছিল, ভালো লাগতো খুব, এবং এই ভেবে গর্ব হতো যে রামালার মতো একটা মেয়ের সাথে আমার সখ্য বা ঘনিষ্ঠতা আছে। এ নিয়ে আমার অন্য বন্ধুরা ঠাট্টা-মশকরা কম করতো না; কেউ কেউ গোপনে গোপনে হিংসাও করতো, তা ওদের চোখ ও আচরণ দেখেই বোঝা যেত।
২
একদিন রামালা ক্লাসে এলো শাড়ি পরে। ছাত্ররা মুগ্ধ হলো, খুব করে রামালার দিকে তাকালো, প্রকাশ্যে বা চোরা চোখে। মেয়েরাও কম তাকালো না ওর দিকে, এবং আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ওর খুব প্রশংসা করলো ওরা। মেয়েদের এরূপ তীর্যক রসালো ঠাট্টাবাক্যে আমি অবাক হলাম। তাহলে কি ওরা জানে, আমি রামালার প্রেমাসক্ত? আশ্চর্য তো! আমার কোনো আচরণে আমি নিজেও টের পাই নি রামালার প্রতি আমার কিছু দুর্বলতা আছে। যতটুকু আছে, তা যে-কোনো ছেলের যে-কোনো মেয়ের প্রতিই আছে। তাহলে? তাহলে রামালাই হয়ত সখীদের সাথে তার প্রেমের কথাটি আলোচনা করে থাকবে।
ক্লাস ছুটি হলে হইচই করে আমরা বাড়ি ফিরছিলাম। আমার বাড়ি উত্তর দিকে, রামালারা দক্ষিণ দিকে যায়। আমি হই-হুল্লোড়ের ভিড়ে বন্ধুদের সাথে গলাগলি করে, হেলেদুলে হাঁটছি। হঠাৎ পেছন হতে লম্বা স্বরে ‘সোনারু’ বলে দুটো ডাক শোনা গেলে আমি ঘুরে তাকাই, দেখি রামালা হাত উঁচু করে ডাকতে ডাকতে আমার দিকে ছুটে আসছে। বাতাসে ওর ক’গোছা চুল মাথার দু’পাশে দুলছে। হাসিমুখে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি অবাক হই না, কারণ, রামালা আমাকে এভাবেই হঠাৎ হঠাৎ ডেকে থাকে; অবাক হলো না আমার সহপাঠীরাও; ওরা এরকম প্রায়শ দেখে থাকে, তাই ওরা যথারীতি দু’পাশে সরে গিয়ে গালিচা-অভ্যর্থনার পথের মতো মাঝখানে রামালার আসার পথ করে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
আমার হাত ধরে রামালা বললো, ‘যাবি? যাবি না? চল যাই।’ বলেই রামালা আমাকে হনহন করে টেনে নিয়ে চললো। আমার সহপাঠীরা এবার অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো, যেভাবে প্রতিবার ওরা অবাক হয় আর আমার চোখ বরাবর কিছু ঈর্ষার ধারালো তীর ছুঁড়ে মারতে থাকে; কারণ, আমি রামালার মতো সুন্দরী গায়িকার ভাগ্যবান পাণিগ্রাহী।
আমরা চলতে চলতে, চলতে চলতে, দ্রুত চলতে চলতে বাড়িমুখো তামাম ছাত্রছাত্রীকে পেরিয়ে কোথায় যেন চলে গেলাম! আমাকে টেনে নিয়ে আগে আগে হাঁটছে রামালা, মন্ত্রমুগ্ধের মতো, কিংবা নির্বোধ কিংবা অন্ধের মতো আমি ওর পেছনে ছুটছি। এতক্ষণ চেনা পথ ধরেই হাঁটছিলাম; সে পথ ছাড়িয়ে হঠাৎ অচেনা পথের শুরু। আমরা ছুটছি, কোথায় কোন গৃহের পানে রামালা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি, আমি জানি না। রামালাকে সে-কথা জিজ্ঞাসা করি, সে-ফুরসৎ হয় না। বড়ো আলোখেলা রাস্তা থেকে আমরা গাছঢাকা অন্ধকার সরু একটা রাস্তায় নেমে গেছি। হ্যাঁ, অন্ধকার! আবছা অন্ধকার থেকে আমরা ঘন অন্ধকারের সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়লাম। আমরা ছুটছি। কী নেশায়, কার হাতছানিতে ছুটছি এখনো জানি না। ছুটতে ছুটতে হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে সরু রাস্তা পার হয়ে সামনে আলোর প্রান্তর। এ আমরা কোথায় এলাম! আশ্চর্য সুন্দর দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। আমরা দাঁড়ালাম। আমাকে ছেড়ে দিয়ে রামালা অবাক হয়ে সামনে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে! কী সুন্দর হৃদয়গলানো নিসর্গ! এতবড়ো মাঠ আগে দেখি নি কোথাও। আমাদের দু’পাশে গ্রামের সারি লম্বা হয়ে বহুদূর চলে গেছে। সামনে ঘাসবিছানো মাঠ ধু-ধু দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। উপরে আকাশ গোধূলির রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে। রামালা দু’হাত মেলে ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘বুক ভরে যাচ্ছে ঠান্ডায়, তাই না সোনা?’ ঝিরঝিরে বাতাসে প্রাণ জুড়িয়ে যায়, রামালা ঠিকই বলেছে। ‘আয়। আয় না সোনা’। ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে আমাকে ডাকে রামালা।
হঠাৎ ঝমঝম করে বৃষ্টি ঝরে পড়লো। আসমানে তাকিয়ে অবাক হয়ে যাই। কোথা থেকে কখন মেঘ জমলো আকাশে? আকাশ কালো হয়ে গেছে। তাইতো পথের ভেতরটা এত অন্ধকার ছিল, আমি মোটেও বুঝতে পারি নি।
দু’দিকে ডানা মেলে বৃষ্টিতে ভিজছে রামালা। ভালো লাগছে আমার। আমার অনেক ভালো লাগছে। আমিও দু’দিকে ডানা মেলে দিই। এই বৃষ্টিতে পাখিরা যেভাবে ডানা ঝাপটে উড়ে বেড়ায় আকাশে, আমারও তেমনি উড়তে সাধ হচ্ছে। আকাশ থেকে বৃষ্টির কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া মাটির প্রান্তর আর বৃক্ষ-বনানি দেখতে কত সুন্দর, আমার তা দেখতে তীব্র ইচ্ছে হচ্ছে।
আমি বৃষ্টিতে ভিজছি। বৃষ্টিতে রামালা ভিজছে।
নৃত্যের ছন্দে চারদিকে পাক খাচ্ছে রামালা। ধীরে ধীরে দুলছে রামালা। ওর চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছে। বৃষ্টিবিধৌত চুলগুলো অনন্য সুন্দর।
আমি রামালাকে দেখি। খুব গভীরভাবে, ঘন হয়ে দেখি। রামালা আপ্লুত। আমি রামালাকে দেখি। প্রকৃতিকে দেখি। সমগ্র প্রকৃতি মূর্ত হয়েছে রামালার অবয়বে। যুবতী রামালা রমণী হয়ে উঠেছে কখন যেন; আমিও যেন থইথই যৌবনে পড়ে আছি কবে থেকে। এই যে গোধূলির আলো-আঁধারীময় বাংলা, আর স্নিগ্ধ কবিতামাখানো রামালা, ওর চুল, চুলের সিঁথি, ঠোঁটের স্মিতহাসি- একাকার হয়ে মিশে আছে। বৃষ্টিস্নাত শাড়ি-পরিহিতা রমণীর চেয়ে সুন্দরতর আর কিছু নেই। আমি রামালাকে দেখি। প্রকৃতিকে দেখি। একধ্যানে দেখি বাংলার মুখ, আর দেখি রামালাকে।
‘সোনা!’ অস্ফুট স্বরে রামালা ডাকে। আমার সামনে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে রামালা। ওর চাঞ্চল্য মুহূর্তে স্তিমিত। ওর দৃষ্টি দূর সমুদ্রের তরঙ্গতুফানে স্থির।
‘হুমম’। আমি অল্প শব্দে সারা দিই।
‘সামনে আয় তো সোনা’।
আমি এগিয়ে রামালার সামনে গিয়ে দাঁড়াই।
‘আরেকটু ঘেঁষে দাঁড়া। আমার বুক ঘেঁষে দাঁড়া।‘
আমি রামালার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ওর চোখে তীব্র আগুনের ফলা।
‘আমার চোখের দিকে তাকা, একদম মণি বরাবর চোখ রাখ।’ তারপর রামালা নিজেই একটু সামনে এগিয়ে আসে, একটু ঝুঁকে আমার নাকের সাথে নাক লাগিয়ে, ঠোঁটের সাথে ঠোঁট ছুঁইয়ে, বুকে বুক ঠেসে একদম আমার চোখের মণি বরাবর ওর চোখের মণি ছুঁড়ে মারলো।
হঠাৎ কী যেন ঘটতে থাকলো।
আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মগজতন্তুগুলো অতিশয় মিহিসুরে রিনরিন করে বাজছে। ঝিম ধরে আসছে পৃথিবী। সূক্ষ্ম একটা কাঁপুনি, তিরতির করে মগজ থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। খুব জোরে সোনারুকে সাপটে ধরে আছি। ওর সর্বাঙ্গ কাঁপছে। না, সোনারু নয়, কাঁপছে রামালা। না, তাও না, সোনারু এবং রামালা – আমরা দুজনেই কাঁপছি। এভাবে কতক্ষণ কেটে যায়, টের পাই না। যখন টের পাই, তখন বুঝতে পারি, আমার খুলির ভেতর একটা মিশ্রিত মগজ কাজ করছে। অর্থাৎ, আমার মগজটা আর আমার একার মগজ নয়, এখানে রামালার মগজটাও ঢুকে পড়েছে। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, আমি নিজেই রামালা।
আমিই রামালা?
‘রামালা…’। আমি ‘রামালা’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠি। না, আমি রামালা নই, আমার শরীরের উপর থেকে রামালা আস্তে ওকে সরিয়ে নেয়। আমার সামনে রামালা দুলছে। ওকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। দুলতে দুলতে ঘাসের উপর বসে পড়ে সে; আমিও ওর সামনে যেয়ে বসে পড়ি। এখন কি রাত? আকাশে জোসনা? চারদিকে আলো খল খল করছে। অপরূপ নিস্তব্ধতায় আমরা ডুবে যেতে থাকি।
‘সোনা!’ নিস্তব্ধতা ভেঙে রামালা বলে, ‘আজ তোকে নিয়ে একটু খেললাম। আমি তোর মগজটা নেড়েচেড়ে উলটপালট করে দিলাম! ভালো লাগছে না তোর?’
‘সর্বনাশ! কী বলছিস এসব?’ আমি রামালার কথায় বিস্মিত হই।
‘তোর উপর একটা পরীক্ষা চালাচ্ছি।‘ আমার চোখ থেকে লেজার রশ্মির মতো খুব ধারালো একটা রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। এটাই সেই ধারালো ম্যাজিক সিজার, যা সবকিছু কাটবে, আবার জোড়াও লাগাবে। সেই রশ্মি দিয়ে খুব ছোট্ট একটা কণা, নিউট্রনের মতো, তোর চোখের মণিতে ঢুকিয়ে দিব।
‘তুই একটা ডাইনি তো!’ দুম করে ওর মুখের উপর বলে দিই; রামালা যেন সত্যিই একটা ডাইনি হয়ে গেল। ওর চোয়াল খুব শক্ত হলো। আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে চোখ থেকে। আমাকে হয়ত ভয় দেখাচ্ছে রামালা। না, আমি সহজে ভয় পাই না। কিন্তু রামালা ধীরে ধীরে নরম হতে থাকলো।
রামালা বলতে থাকে, ‘শোন সোনারু, আমি তোর ব্রেইনের ভেতর ঢুকে পড়বো। অতিক্ষুদ্র একটা দানার ভেতর আমার ব্রেইনের সবখানি মেমোরি ঢুকিয়ে নেব। তোর চোখ বরাবর একটা ফুঁ দিব, তারপর রেটিনা দিয়ে সুড়সুড় করে তোর নিউরনে ঢুকে পড়বো। তোর মগজ ঘাঁটাঘাঁটি করে উচ্ছিষ্ট অংশটা রেখে আবার আমার ব্রেইনে চলে আসবো।‘ এ বলে রামালা দুষ্টুহাসি ছড়িয়ে দিল মুখে।
আমি একটু উত্তেজিত স্বরে জিজ্ঞাসা করি, ‘আচ্ছা রামা, কেন শুধু শুধু আমাকে নিয়ে খেলছিস? জগতে কি আর কেউ ছিল না?’
রামালা হাত বাড়িয়ে আমার গাল
Comments (0)